মুক্তিবেগ, অভিকর্ষ, ব্ল্যাক হোল ইনফরমেশন প্যারাডক্স
ব্ল্যাকহোল, পদার্থবিজ্ঞান / জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে আলোচিত একটি জনপ্রিয় বস্তু। রাতের আকাশে দৃশ্যমান অন্যান্য তারা কিংবা নক্ষত্রের আবিষ্কার অনেকটা পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করে হলেও ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ বিবরের আবিষ্কার কিন্তু অনেকটাই তাত্ত্বিক বলা চলে। কেননা ব্ল্যাকহোল আদৌ দেখতে কীরকম তা পর্যবেক্ষণ করে বোঝা খুব একটা সহজ নয়।
ব্ল্যস্কহোল আবিষ্কারের গল্পটা অনেক আকর্ষণীয়। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র থেকে আমরা জানি যে পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু একে অপরকে একটি নির্দিষ্ট বলে আকর্ষণ করছে। তবে এই আকর্ষণ বলের কিন্তু ধ্রুব (Constant) নয়। প্রতিটি বস্তুর একে অপরকে যে বলে আকর্ষণ করে তা নির্ভর করে সেই বস্তুগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব, বস্তুদের নিজেদের ভরের ওপর।
যদি m1 এবং m2 ভরের দুটি বস্তু একে অপরের থেকে d দূরত্বে অবস্থান করে, তাহলে তাদের মধ্যবর্তী আকর্ষণ বলের মান হবে,
F∝ m1m2d2
সুতরাং বলা যায় দুটি বস্তুর মধ্যবর্তী আকর্ষণ বল বস্তু দুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক অর্থাৎ F∝m1m2 এবং এদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক অর্থাৎ F∝1d2.
কিন্তু ভাই এই সমানুপাতিক ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক দিয়ে তো পদার্থবিজ্ঞান সাধনা করা কষ্টের। তাই এই সমানুপাতিক এবং ব্যস্তানুপাতিকের সম্পর্কে চির ধরানোর জন্য উদয় হয় মহাকর্ষীয় ধ্রুবক বা Gravitional Constant, G এর। তখন সূত্রটি দেখতে হয় এমনঃ
F= G m1m2d2
মহাকর্ষীয় ধ্রুবক কী?
তো মহাকর্ষীয় ধ্রুবক হচ্ছে সে বলের মান যে বলে একক ভরের দুটি বস্তুকে একক দূরত্বে রাখলে যে বলে একে অপরকে আকর্ষণ করে। অর্থাৎ 1kg ভরের দুটো বস্তুকে পরষ্পর থেকে 1m দূরত্বে স্থাপন করলে যে বলে এরা একে অপরকে আকর্ষণ করে সেই আকর্ষণ বলের মানই হচ্ছে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক বা G.
মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের একক
মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের একক হচ্ছে Nm2kg−2. মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের এককের মান নির্ণয় করা খুবই সহজ। আমাদের দেশের স্কুল কলেজ গুলোতে ম্যাক্সিমাম টাইমেই বলা হয় বিভিন্ন এককের মান মুখস্থ করার জন্য। এটি আসলে ঠিক না। মুখস্থ করে কখনও কোন কিছু শেখা যায় না। বিশেষ করে গণিত পদার্থবিজ্ঞানে তো না-ই। সেটা সূত্র হোক আর যাই হোক। কোন কিছুই মুখস্থ করা উচিৎ নয়। মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের একক বের করা যায় এর সূত্র থেকেই।
অভিকর্ষ
যেকোন গ্রহ / নক্ষত্র ইত্যাদিও নিউটনের এই মহাকর্সূষ ত্র মেনে চলে। নিউটন আরও বললেন যে পৃথিবীর পৃষ্ঠের সকল প্রকার বস্তুকে পৃথিবী একটি নির্দিষ্ট বলে আকর্ষণ করে টেনে ধরে রেখেছে। তবে এই আকর্ষণ বলের মান বস্তুর ভরের ওপর নির্ভর করেনা। একে বলা হয় অভিকর্ষ বল। যা g দ্বারা প্রকাশ করা হয়। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র হতে আমরা জানি,
F= G MmR2
যেখানে M হচ্ছে পৃথিবীর ভর এবং m হচ্ছে পৃথিবীর পৃষ্ঠের ওপর কোন বস্তুর ভর এবং R হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্র হতে বস্তুর মধ্যবর্তী দূরত্ব।
আবার নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র হতে আমরা পাই,
F=mg
এখানে F এর জায়গায় G MmR2 বসিয়ে পাই,
mg = GMmR2
বা, উভয়পক্ষ থেকে m ভাগ করে দিয়ে পাই,
g = GMmR2
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে অভিকর্ষজ ত্বরণ বস্তুর বস্তুর ভর নিরপেক্ষ। অর্থাৎ পৃথিবীর পৃষ্ঠ হতে h উচ্চতা থেকে ১ কেজি ভরের লোহার টুকরা এবং ১০ গ্রাম ভরের কাগজের বল একই সময় বিনা বাঁধায় পড়তে দিলে একই সময়ে দুটি বস্তু পৃষ্ঠে পড়বে।
কিন্তু কথা হচ্ছে বাস্তবে যখন আমরা এই পরীক্ষাটি পর্যবেক্ষণ করতে যাই তখন তো আমরা ভারী বস্তুকেই আগে মাটিতে পৌছাতে দেখি। কেন এমন হয়? এর কারণ হচ্ছে বাতাসের বাঁধা (Friction). কোন বস্তু যখন মুক্তভাবে পড়তে থাকে তখন সেই বস্তুর ওপর বাতাস দ্বারা ঘর্ষণ বা বাঁধার সৃষ্টি হয়। তাই ভারি বস্তু আগে এবং কম ভারি বস্তু দেরিতে মাটিতে পড়ে।
তবে অভিকর্ষজ ত্বরণ বস্তু নিরপেক্ষ হলেও স্থান নিরপেক্ষ নয়। কারণ যখন আমরা নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র সম্পরররকে জেনেছি তখন দেখেছি যে বস্তুদের মধ্যবর্তী কৃয়ারত আকর্ষণ বল বস্তুদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ওপরও নির্ভর করে। যখন আমরা অভিকর্ষের সূত্র প্রতিপাদন করি তখন আমরা বস্তুকে পৃথিবীর পৃষ্ঠে কল্পনা কএই। পৃথিবীর কেন্দ্র হতে পৃষ্ঠের দূরত্ব হচ্ছে প্রায় 6400km. এখন কোন বস্যু যদি পৃথিবীর পৃষ্ঠ হতে h উচ্চতায় থাকে তখন পৃথিবীর কেন্দ্র ও বস্তুর মধ্যবর্তী দূরত্ব হবে (R+h)km এবং তখন সূত্রটি হবে
g = GMm(R+h)2
মুক্তিবেগ
F= GMmr2
যেখানে F হচ্ছে দুটো বস্তুর মধ্যকার আকর্ষণ বল, M এবং m হচ্ছে দুটো বস্তুর ভর। পৃথিবীর হিসাবে M হচ্ছে পৃথিবীর ভর এবং m হচ্ছে বস্তুর ভর। এখন, বস্তুকে মহাকর্ষ বলের বিরূদ্ধে শূন্যের কাছাকাছি দূরত্ব dr পরিমাণ সরাতে বস্তুটির গতিশক্তির নিমিত্তে যে কাজ করতে হবে তা হলো,
dW=Fdr
বা, dW= GMmdrr2
এখন, বস্তুটিক ভূপৃষ্ঠ হতে ∞ দূরত্বে নিয়ে যেতে মোট কাজ সম্পাদিত হবে,
W=∫∞R GMmdrr2
বা, W=GMm[−1r]∞R
বা, W=GMmR
এখন,
W=GMmR
বা, 12mv2=GMmR
বা, v2=2GMR
বা, v=√2GMR .......... (1) [যেখানেঃ v = মুক্তিবেগ]
ব্ল্যাকহোল কী?
মহাবিশ্বের যেসকল স্থানে অসীম ভরের কোন বস্তুর উপস্থিতি থাকে সেখানেই এরূপ গর্তের সৃষ্টি হয় যা স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়। কৃষ্ণ বিবর বা ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষ এত বেশি যে এর থেকে মহাশূন্যে আলোও বিকরিত হতে পারে না।
আবার, V=43πR3
এখন V এর মান M=ρV সমীকরণে বসিয়ে M এর মান বের করা যায় এবং সেই মান (1) নং সমীকরণে বসিয়ে পাওয়া যায়,
v=√8πρGR3
এখানে সূর্যের গড় ঘনত্বের মান বসিয়ে আমরা পাই,
v=6.18×105ms−1
যা সূর্যের মুক্তিবেগ। অর্থাৎ সূর্যের পৃষ্ঠ হতে এই বেগে কোন বস্তুকে ছুঁড়ে মারলে তা আর সূর্য পৃষ্ঠে ফিরে আসবে না। এখন, আবার আমরা জানি, আলোর বেগ, c=3×108ms−1 এবং, সূর্য পৃষ্ঠের মুক্তিবেগ আলোর বেগের প্রায় ৪৮৬ ভাগের এক ভাগ। আবার মুক্তিবেগ v∝R
অর্থাৎ মুক্তিবেগ সূর্যের ব্যাসার্ধ এবং গড় ঘনত্বের উপর নির্ভর করে। এখন, কোন বস্তুর ঘনত্ব যদি সূর্যের সমান কিন্তু এর ব্যাসার্ধ সূর্যের ৪৮৬ গুণ হয় তবে বস্তুটির পৃষ্ঠে মুক্তিবেগ হবে আলোর বেগের চাইতেও বেশি!! অর্থাৎ তখন ওই বস্তু হতে আলোও ফিরে আসবে না। বস্তুটি আলোকে আকর্ষণ করবে। মূলত এই বস্তুগুলোকেই ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ বিবর বলা হয়।
মুক্তিবেগের সূত্র, v=√8πρGR3 তে সূর্যের গড় ঘনত্ব 1410kgm−3 এবং ব্যাসার্ধ R=486×6.96×108 বসিয়ে পাই,
v=3.0095×108 যা কিন্তু আলোর বেগের থেকে বেশি!!
এখন আলো যেহেতু কণা এবং তরঙ্গ উভয়ের ন্যায় আচরণ করে, সুতরাং বলা যায় আলো মহাকর্ষ বল দ্বারা প্রভাবিত হবে। কিন্তু, স্বাভাবিক অবস্থায় মহাকর্ষ বল G এর মান এতই কম যে মহাকর্ষ বল আলো তো দূরে থাক, আমরা মানু্ষেরাও অনুভব করতে পারি না৷ তবে ব্ল্যাক হোলে মহাকর্ষ বলের মান প্রায় অসীম বলা চলে। এবং ব্ল্যাক হোল থেকে যেখানে আলো ফিরেই আসতে পারে না, সেখানে ব্ল্যাক হোলকে দেখতে পারা তো দূরের কথা।
4 comments